এটা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত যে, বর্তমানে বা বেশ কিছই দশক ধরে বিবাহ-বিচ্ছেদের হার নারীদের কাছে থেকেই প্রস্তাবিত হচ্ছে বেশী।
এবং এই বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রসঙ্গ উঠলেই এই কথাটা প্রায়ই শুনি যে, "মহিলারা শিক্ষিত হবার গতির সাথে তালাকের সংখ্যা বাড়ছে!" যেটা গৌণভাবে ধরা হয়ে থাকে, মেয়েরা শিক্ষিত হবার সাথে সাথে উচ্ছেন্নে যাচ্ছে! তারা HOME-MAKER থেকে HOME-WRECKER প্রবন হচ্ছে এবং আরো ইত্যাদি ইত্যাদি কন্সপিরেসি তত্ত্ব।
এবং এটা যে আমাদের পুরুষ সম্প্রদায় কেবল একটা কথার কথা বলে, তা কিন্তু নয়। এর সাথে সমপরিমাণ শ্লেষ, দ্বেষ, এবং অবজ্ঞা মেশানো থাকে।
বি:দ্রঃ [যদিও বৈশ্বিক বিচারে এখন বিবাহ কেবল পুরুষ নারীতেই সীমাবদ্ধ না, তবে যেহেতু বিবাহের আদি ধারণা হিসাবে এবং সর্বাধিক প্রচলিত প্রথা অনুসারে বিপরীতের মানুষটি (এবং সমাজবিজ্ঞানের আপাত সঙ্গায়) পুরুষ, তাই মতাদর্শের এই দ্বন্দে পুরুষকেই মূল প্রতিপক্ষ হিসাবে গণ্য করলাম।
অবশ্যি এমন অনেক নারীও আছে যাদেরকে আমরা "মিসোজিনি" বলে থাকি (যে নারীরা নারীর ভালো চাইতে এবং সহ্য পারেনা); যারা ওই একই মতাদর্শে চালিত এবং প্রয়োজনে আবেগ, বিবেকের প্রশ্ন তোলা হাতিয়ারও ব্যবহার করতে প্রস্তুত কিন্তু কোনোক্রমেই ভিন্ন ধারায় শামিল হতে অনিচ্ছুক সেটা যদি কোনো মহৎ স্বার্থেও হয়ে থাকে।
সবথেকে অবাক করা ব্যাপার এই যে, যখন অর্ধ বা স্বশিক্ষিত নয় মানুষের কাছে শুনি তখন অন্তত একটা অজুহাত পাই যে এদের দৃষ্টিভঙ্গি সরলরৈখিক এবং একরোখা; কিন্তু এই প্রজন্মের আধুনিক মনা (যেটা যুগের অগ্রগতিতে অপ্রতিরোধ্য যে কারো জন্য) মানুষেরা, যাদের দেখার, জানার, শোনার পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত, তারাও কেমন যেন এই ব্যাপারটায় এসে একরোখা, গোঁড়ামির পরিচয় বেশ সগর্বেই রেখে যেতে চায়।
এবং সবচেয়ে বেশী যে মন্তব্যটি শোনা যায়, "আগেতো এতো ডিভোর্সের ব্যাপারটা ছিলোনা। কারণ নারীরা সংসারের গন্ডিতে আবদ্ধ থেকে সুখী ছিল!"
এই মন্তব্য শোনার পর আসলে প্রতিপক্ষের সাথে দু'কথা বলার সদিচ্ছে বা রুচি কোনোটাই আসলে থাকেনা।
এমনকি যদি বলিও বা জানতে চাইও যে, "আগে নারীরা সুখী ছিল বলেই যে বিবাহ-বিচ্ছেদ অতো হতোনা এই মন্তব্যের ভিত্তিটা আসলে কোথা হতে এসেছে? তারা যে আসলেই সুখী ছিল, এবং সমাজ সংসারের চাপে ও স্বনির্ভর না হবার দরুণ নিরুপায় ছিলোনা কেন পারেনা?" জাতীয় প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়না।
সেই একই একগুঁয়ে সুরে গেয়ে যায়, "সুখী ছিলেন বলেই বিচ্ছেদ হতোনা, আর বিচ্ছেদ হতোনা বলেই সুখী ছিল"
কিরে বাপু, এ কি অদ্ভুত "যায় বলো তালগাছ আমার" তত্ত্ব
এটা অবশ্যই সত্য যে, যখন থেকে মেয়েরা শিক্ষায়, কর্মে বহির্মুখী হতে শুরু করেছে, যখন থেকে নিজের সত্ত্বাকে আত্মনির্ভরশীল হতে দেখেছে, যখন থেকে উপলব্ধিতে এসেছে যে, তাদেরও " পছন্দমতো বেছে নেবার অধিকার এবং উপায় উভয়ই আছে", তখন থেকে কোনো মানুষটি সেসব বেছে নেবে না?
আমার বেশ আফসোস এবং আক্ষেপ হয় এই ভেবে যে পুরুষরা যে তাদের পুরুষত্বের ধারণা নিয়ে কতটা বিপথগামী এ বোধকরি তারা নিজেরাও জানেনা, কিংবা জানলেও ওই একই ভুল দর্শনের কারণে মানতে চায় না।
একজন নারী যদি বিচ্ছেদের দাবি জানায়, তাহলে কিন্তু অর্থ-সামাজিকভাবে নারীরই তসরুফের পাল্লা ভারী থাকে।
১. কর্মের পরিবেশের অপ্রতুলতা
২. স্বামীর ঘর ছাড়ার পর বাবার বাড়িতে আশ্রয় না পাওয়া
৩. নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব
৪. সামাজিক তিরস্কার ও প্রায় নির্বাসিত
প্রশ্ন রেখে যায়, বাকি অন্যান্য অসুবিধা ছাড়াও, এই যে প্রধান ৪টি বিড়ম্বনা একজন নারী বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে পোহাতে হবে জেনেও যখন সে সিদ্ধান্ত নেই, তখন আপনার মনে হয় না, "তবুও কেন?"
আবার আপনারা মেয়েদের আরো একটা তকমা দেন, "গোল্ডডিগার"/ "পুরুষের টাকা দেখে বিয়ে করে"/ "সরকারি চাকরিওয়ালা ছাড়া বিয়ে করেনা"
বিয়েতো হচ্ছে পরিবার থেকে, তাহলে দায়ভার এক মেয়েটার কেন? তার থেকেও বড় কথা, কখনো ভেবে দেখেছেন আসলে এই প্রয়োজনীয়তাটা কেন বোধ করে?
বলে রাখি, পুরুষে যেমন খামতি আছে, নারীতেও আছে। পুরুষ সুন্দরী, তন্বি, কচি নারী পছন্দ করে, নারী সুদর্শন, পর্যাপ্ত অর্থের যোগান দিতে পৰ পুরুষ পছন্দ করে।
অর্থওয়ালা পুরুষ সুন্দরী নারী নিয়ে যাচ্ছে। আর দরিদ্র প্রেমিক পুরুষ নারীকে শাপশাপান্ত করছে, বিস্বাসঘাতকীনি বলছে, ছলনাময়ী বলছে।
এই ব্যাপারগুলোর সাথে আরো একটা প্রসঙ্গ জড়িত আছে।
কর্মের সংস্থান আর সংসারের দায়িত্বের সুষম বন্টন।
আমাদের বর্তমান সংস্কৃতি আর সভ্যতায়, মেয়েরা শিক্ষিত হলেও, তাদের কিন্তু সেরকম কর্মের যোগান নেই। যতটা শিক্ষায় এগিয়েছে, ততটা কর্মের সংস্থানে জেনো ঠিক ততটাই পিছিয়ে আছে।
কর্মের পরিস্থিতি আর পরিবেশ নেই। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।
পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষার প্রতি জোরাজুরি যেমন কম, কাজের পরিধি মেয়েদের জন্য ততটাই বেশী। উদাহরণ দিতে যাবোনা, যারা পড়ছেন তাদের জানার পরিধি অতন্ত ততটুকু বিস্তৃত আছেই।
আবার নারী চাকরি করলেও তাকে এক হাতেই সংসারও সামলাতে হচ্ছে। আমাদের পুরুষরা পাতিল থেকে পাতে ভাত নিতে রাজ্য জুড়িয়ে যায়, রান্না, ঘর-দোর ঝাড়-পোছ কিংবা আনুষঙ্গিক অন্য কাজে বাটানোর প্রশ্নই আসেনা।
তো নারীরই আসলে কিসের দায় এতো?
আমি একজন শতভাগ ক্যারিয়ারিস্ট মহিলা।
কিন্তু আমি গোল্ডডিগার খেতাব মাথা পেতে নিয়ে পয়সাওয়ালা কাউকেই বিয়ে করতে চাই।
আমি চাকরি একটা করবো, দুটো সম্ভব নয়।
হয় আমি বিয়ে করবো এবং সংসার সামলাবো, অথবা আমি চাকরি করবো এবং বিয়ে করবোনা।
বিয়ে করে সংসারও সামলাবো, চাকরিযে করবো সেটি হবেনা।
যেই নারীরা দুটোই করছেন, তাদের প্রতি আমার কোনো অশ্রদ্ধা নেই, আবার শ্রদ্ধাও নেই সত্যি বলতে। বরং আমি অনুভব করি ফ্রি সেক্সের জন্য এরকম অমানবিক একটা জীবন বেছে নিয়েছেন বলে করুণা অনুভব করি।
আমার কিছু শখ আহ্লাদ আছে, আমার দৈন্দন্দিন যাপিত জীবনে নিয়মিত অবসরের প্রয়োজনীয়তা আছে, আমার মন খারাপ, অনিচ্ছেদের আহ্লাদ আছে।
সংসারের সমস্ত ঝঞ্ঝাট শেষে আমার বারান্দায় বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাবার আহ্লাদ লাগবে, মন খারাপ বলে ছুটি সুযোগ লাগবে, মাঝে মাঝে ঘুরতে যাবার অবকাশ লাগবে, চিন্তা করবার, চিন্তাটাকে অক্ষরে সাজিয়ে চেয়ে দেখবার সময় লাগবে, গাছেদের সাথে গল্পের ফুরসৎ লাগবে।
সুতরাং আমি যেকোনো একটা চাই, হয় সংসার ও বিয়ে, অথবা চাকরি ও বিয়েহীন জীবন।
দুটো আমার দ্বারা হবেনা।
কারো দ্বারা হোক এই কামনাও করিনা।
তবে পশ্চিমা দেশে যেরকম শোনা যায়, সংসার কেবল নারী না, নারী-পুরুষ দুজনে মিলেই করছে, সেক্ষেত্রে চাকরি আর সংসার দুটোই করা অসম্ভব না।
তবে এই বাঙ্গু দেশে সেইটা সম্ভব বলে মনে হয়না।
All the contents are mine untill it’s mentioned otherwise.