মানুষ তার অতীতের স্মৃতিগুলোর কাছে ফিরে যাবার জন্য কখন ব্যাকুল হয়ে পড়ে? যখন তার বর্তমান অতীতের স্মৃতিগুলোকে মস্তিষ্কে লালন করে বেড়ায় এবং সে স্মৃতির মধ্যে পরম সুখ অনুভব করে ঠিক তখনই বর্তমানকে তুচ্ছ মনে করে তার অতীতের স্মৃতিকে ফিরে পাবার জন্য বেকুল হয়ে পড়ে। আমি একটি জিনিস খুবই গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছি, আমরা যখনই আমাদের অতীতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কিছু বলতে যাই, তখনই আমাদের আশেপাশে একদল বলে উঠে, বর্তমানে বাস করে যদি, অতীতের চিন্তায় নিমগ্ন থাকি তাহলে আয়াদের উন্নতি হবে কিসে!
এ উক্তিটিতে অতীতের স্মৃতিচারণটাকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে বরং বর্তমানের উপর বাঁচার প্রতি জোর দেয়া বুঝানো হয়েছে। আমার মতে মাঝে মাঝে অতীতের সুখকর স্মৃতিচারণ করা ও জরুরি যদি আপনার বর্তমান অত্যাধিক তিক্ততায় রূপ নেয়। আজ এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয় সন্ধ্যার পর, আমরা চারজন ছিলাম তখন। ভদ্রলোকটি'র সাথে আমার কিছুদিন আগেই আমার পরিচয় ঘটে। শিক্ষিত, ভদ্র, মিশুক ও সুদর্শন পুরুষ বটে উনি। বয়সে আমাদের থেকে দিগুণ হবে, কারন চল্লিশের কোটায় উনি, কথা বলার মধ্যে কোনো প্রকার সিনিয়রিটি ভাবটা আর রাখলেন না, আমাদের সাথে মিশে আমাদের একজন হয়ে চায়ের আড্ডায় ঝড় তুলেন।
সচরাচর উনার সাথে বেশকিছুদিন ধরে আমাদের চায়ের আড্ডাটা ভালো জমছে। কিন্তু আজকের আড্ডার ব্যাপারটা ছিল একদমই আলাদা। চায়ের চুমুক দিতে দিতে উনি ডুব দিলেন উনার অতীতের স্মৃতিচারণের করতে, আর আমি অতি আগ্রহী হয়ে তার সে স্মৃতির মুহুর্তগুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম। তখন তার বাবা ভালো পদের একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন আর সে সূত্রে তার বেড়ে উঠা ময়মনসিংহ শহরে। আর সেখানে ঘিরেই তার শৈশবের সব স্মৃতি। সেখানেরই একটি সনামধন্য স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ারত অবস্থায় তার বাবার পোস্টিং এর কারনে সে স্থান ছেড়ে চলে আসতে হয় তাদেরকে।
সেদিন সে স্কুল থেকে আসা মাত্রই, বাড়ি ফিরে দেখলো, তার বাবা তাকে বলছে তারা এখনই এখান থেকে চলে যাবে। তখন সে ভীষণ ছোট্ট ভালো মতে কিছু বুঝে উঠতে না পারার আগেই তাকে তার পরিবারের সে শহর ছেড়ে বহুদূরে অন্য শহরে চলে আসতে হয়। কিন্তু তার স্মৃতির পাতার তার স্কুল বন্ধুদের আর ভুলতে পারে না। তখন সময়টা ছিল ১৯৮৭ সাল তখন যে যোগাযোগে এর মাধ্যমে হিসেবে মোবাইল ছিল তাও বলা যাবে না। বহু সময় কেটে গেলেও সে তার শৈশবের বন্ধু কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না। তার ইচ্ছা বড় হয়ে একদিন সে তার সিফাত বন্ধুর সামনে যাবে।
তখন ১৯৯৭ সালের কথা সে উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষা শেষে, সাহস করে যে, সে তার শৈশবের সেস্থানে যাবে তার বন্ধুর সাথে দেখা করতে। সেখানে তার বন্ধুর বাড়ির রাস্তাটা তার কোনো রকম মনে আছে কিন্তু এত বছর পর এসে, সে আর কিছুই চিনতে পারতেছিল না। অবশেষে আশেপাশের দোকানদারদের জিজ্ঞাসা করে সিফাতের বাসা খুঁজে বের করলই। সিফাতের বাড়ি গিয়ে তার নাম ধরে ডাকতেই তার মা বেড়িয়ে এলো। সিফাত বাড়ি আছে? সিফাতকে একটু ডেকে দিন না, এ কথা বলতেই সিফাত এলো বাড়ি থেকে বের হয়ে।
-আপনিই কি সিফাত?
-জ্বি। কেন?
--আপনি কি অর্পণ নামে কাউকে চিনতেন?
ক্ষণিক ভেবে উত্তর দিলো, হ্যা। সে ত আমায় কিছু না বলে অনেক আগেই তার পরিবারে সাথে অন্য শহরে চলে গেছে।
-আমিই সেই অর্পণ।
একথা বলতে না বলতেই সিফাত অর্পণকে জড়িয়ে ধরে। সে কখনো ভাবে নি যে অর্পণ তার জন্য এতদিন পরেও একবার হলেও তার সাথে দেখা করতে আসবে।
মাঝে মাঝে অতীতের ফিরে গেলে তা বর্তমান থেকে ও বহুগুণ বেশি সুখ, আনন্দ ও পরিতৃপ্তি দেয়। তাই বর্তমানের তিক্ততা দূর করার জন্য অতীতের সুখকর স্মৃতিচারণ করাও বেশ জরুরি।