১৯৯৮ বিশ্বকাপ। যুগোশ্লাভিয়ার থেকে সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে ছোট এই দেশটি। নাম ক্রোয়েশিয়া। বিশ্বের কাছে নিজেদের জানান দিতে বিশ্বকাপের চেয়ে ভালো সুযোগ আর কি আছে? সেই সুযোগটিই ক্রোয়েশিয়া পেয়ে গেলো ১৯৯৮ এর বিশ্বকাপে। দেশটা নতুন হলে কি হবে, তাদের ভালোবাসায় ফুটবল, ইউরোপের দেশ বলে কথা। তাদের দলে আছে বেশ কয়েকজন বাঘা-বাঘা প্লেয়ার। ডিনামো জাগরেব এর কথা নাহয় বাদ, তাদের আছে বিশ্বখ্যাত এসি মিলান-জুভেন্টাস-রিয়াল মাদ্রিদ এ খেলা প্লেয়ার। যুগোস্লাভিয়ার হয়েও খেলেছেন অনেকে। কিন্তু দেশের টানে, যোগ দিয়েছেন ক্রোয়েশিয়াতে। দেশকে নিয়ে গেছেন বিশ্বকাপের আসরে।
ক্রোয়েশিয়ার জন্য দরকার ছিল এমন একজন কোচ, যিনি অভিজ্ঞ, যিনি খেলোয়াড়দের চেনেন, দেশকে ভালোবাসেন আর দেশপ্রেমকে কাজে লাগিয়ে দলের থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারবেন। ক্রোয়েশিয়া পেয়েছিলো এমনই একজন কোচ, মিরোস্লাভ ব্লাজোভিচ। তিনি যেমনই দক্ষ, তার দেশপ্রেমও ছিল তেমন। দেশের স্বাধীনতার পিছনে কাজ করা Croatian Democratic Union এর সক্রিয় সদস্য তো ছিলেনই, সাথে ছিলেন ডিনামো জাগরেব এর প্রেসিডেন্ট ও কোচ। চিরো নামে সবাই চিনেন তাকে। দেশে তাকে বলা হয় "সকল কোচের কোচ" (পরে তিনি সুইজারল্যান্ড, ইরান, বসনিয়া হার্জোগুয়েভিনা, চায়নার কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন)।
একটু পিছনে ফিরে যাই। ১৩ই মে ১৯৯০ সাল। মাক্সিমির স্টেডিয়ামে এক পুলিশকে লাথি মেরে ন্যাশনাল হিরো হয়ে যান বোবান। বলা হয় এই লাথির জন্য শুরু হয় যুদ্ধের। জ্বি হ্যা, উয়েফার চিফ অফ ফুটবল জনোমির বোবান। তিনিই হলেন দেশের অধিনায়ক। দেশের নতুন পতাকা, নতুন পরিচয়ে কোয়ালিফাইয়ারে ইউক্রেনকে পিছনে ফেলে চলে আসলেন ফ্রান্স এ। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ, ফ্রান্স। হারাবার কিছু নেই, নকআউট স্টেজে যেতে পারলেই ঢের। বিশ্বের দরবারে অনেকে নতুন একটা দেশের নামতো অন্তত জানতে পারবে!
দেশের বিশ্বকাপের প্রথম খেলা, জামাইকার সাথে। প্রথমেই গোল করেন মারিও স্টানিচ। কিন্তু ম্যাচে সমতা এনে ফেলে জামাইকা। অসাধারণ এক গোলে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন রবার্ট প্রজিনেস্কি। কোচ চিরো বলেছিলেন, প্রজিনেস্কি যদি কোনোদিন ভালো খেলোয়াড় হয়ে যান, তাহলে তিনি একটা কোচিং ডিপলোমা নিবেন। চিরো খুব ভালো করেই জানতেন যে প্রজিনেস্কি তাকে ভুল প্রমাণ করে ছাড়বে। প্রজিনেস্কির যখন ১৭ বছর বয়স তখন থেকেই চিরো তাকে কোচিং করান। সেই ডিনামো জারগেব এর দিন থেকেই। সে যে কত সেরা, তার নমুনা ছিল এই গোলেই। পরের গোলটা দেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা ডাভর শুকার। ৩-১ গোলে জিতে যায় ক্রোয়েশিয়া।
জাপানের বিরুদ্ধে ম্যাচের ১ মাত্র গোলটি দেন আবারো ডাভর শুকার। পরের ম্যাচে আর্জেন্টিনার ১-০ গোলে হারলেও, নকআউট পর্বে পৌঁছে যায় ক্রোয়েশিয়া।
রাউন্ড অফ সিক্সটিনে প্রতিপক্ষ রোমানিয়া! পেনাল্টি বক্স এ স্পটকিক থেকে গোল করে ১-০তে জিতিয়ে দেন ডাভর শুকার। ৪ ম্যাচে তিন গোল তার!
এখন কোয়ার্টার ফাইনাল! মুখোমুখি নকাউট স্টেজের মাস্টার, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন জার্মানির সাথে!! প্রচণ্ড ফিজিক্যাল এই খেলায় জার্মানি ম্যাচের প্রথমার্ধেই পেয়ে যায় একটি লাল কার্ড। তারপর আর ঠেকায় কে! সাবেক জুভেন্টাস-রিয়াল তারকা রবার্ট ইয়ারনি প্রথম গোল করেন। ডি-বক্স এর বাইরে থেকে করেন চোখ জুড়ানো শট! পরের গোলটা ভালাওভিচের। তবে ওস্তাদের মার যেমন শেষ রাতে, তেমনি ৮৫ মিনিটে গোল করেন ডাভর শুকার! আবারো!
দেখতে দেখতে সেমিফাইনাল। বিপক্ষে স্বাগতিক ফ্রান্স! ডিফেন্সে অনেক হাই লাইন মেইন্টেইন করে, অফসাইড ট্র্যাপে খেলছিল ফ্রান্স। হঠাৎ থুরাম এর ভুলে ডিবক্সের সামনেই বল পেয়ে যান ডাভর শুকার। ঠাণ্ডা মাথায় বল জালে জড়িয়ে আসেন তিনি। সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ! ক্রোয়েশিয়া ১-০ গোলে এগিয়ে। তার ঠিক ১ মিনিট পরে সারা বিশ্ব এমনকি তার সতীর্থদের অবাক করে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে গোল করেন লিলিয়ান থুরাম! ফ্রান্সের হয়ে ১৪২টা ম্যাচ খেলেছিলেন থুরাম, তার প্রথম গোল ছিল এই গোলটাই। এবং তার ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারের ২য় ও সর্বশেষ গোলটাও আসে এই ম্যাচেই। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, জাতীয়দলের হয়ে আর কখনোই গোল করেননি তিনি! দুঃখের বিষয়, ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে সেরা প্লেয়ার এসি-মিলান তারকা, ক্যাপ্টেন বোবান হাফ টাইমের আগেই ইঞ্জজুর্ড হন। হাফ টাইমেই তার সাবড হবার কথা থাকলেও শেষমেষ ৬৫ মিনিটের দিকে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। আর সেইবার ফ্রান্সই বিশ্বকাপ জয়ী হয়!
৩য় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে, নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হয় ক্রোয়েশিয়া। ভ্যান্ডারসারকে পরাজিত করে প্রথমেই গোল করেন প্রজিনেস্কি। ম্যাচে সমতা নিয়ে আসে ডাচরা। জয়সূচক গোলটা করেন ডাভর শুকার। যেনো গোলটা তারই করার কথা ছিল। ডাভর শুকারের এইটা ছিল ৭ নম্বর গোল। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে তিনিই জিতে নিয়েছিলেন গোল্ডেন বুট।
বিশ্বকাপ ইতিহাসে অনেক ডার্ক হর্স থাকবে। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার ৯৮ এর ডেবিউ দলের মত আর কোন দল থাকবে না কি জানি না।
গ্রেটেস্ট ওয়ার্ল্ডকাপ ডেবিউ এভার?