অ্যান্টনি ম্যাথিউস দস স্যান্তোস। একদম জাহান্নামেই জন্ম হয়েছিল অ্যান্টনির। না মজার ছলে বলার জন্য বলা না, অ্যান্টনির বস্তিকে ইনফার্নিনহো বা ছোট নরক বলা হয়। আপনি যদি অ্যান্টনিকে খুব কাছের থেকে চিনেন বা সাউ পাউলোর এই বস্তিগুলো সম্পর্কে জানেন তাহলে আঁচ করতে পারবেন অ্যান্টনির ইতিহাস।
বাড়ির সদর দরজা থেকে ১৫-কদম দূরেই সবসময় ড্রাগ-ডিলাররা ডিল করতেন। হাতে হাতে ড্রাগ ডিল চলছে, বাতাসে উটকো একটা গন্ধ সব মিলিয়ে শীতল বিচ্ছিরি এক পরিবেশ। ছোটবেলার একটা স্মৃতি মনে আছে অ্যান্টনির, বাইরের শোরগোলের জন্য খেলা দেখা যাচ্ছে না শান্তিমতো, চেয়ার থেকে উঠে বাসার সামনের ড্রাগ-ডিলারদের বকতে গেলেন বাবা। বস্তি নিয়ে স্মৃতিগুলো এমনই অ্যান্টনির।
পিস্তল -বন্দুক দেখে ভয়ই লাগে না তার। আসলে বছরের প্রতিদিন যদি পিস্তল দেখেন ভয়টা কি আর থাকে? পুলিশকেও ভয় লাগতো না অ্যান্টনির। একদিন সুন্দর এক সকালে দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করতে করতে আসলো একদল পুলিশ। তোলপার করে তল্লাশী চললো। কেন? কারণ এলাকার এক ক্রিমানালকে খুঁজছিল পুলিশ। না পেয়ে সুন্দর মতো চলে গেলেন তারা। ছোট-ছোট এমন ঘটনা শিশুবয়সে বেশ দাগ কেটেছিল অ্যান্টনির মনে।
এইখানেও শেষ না। অ্যান্টনির এমন অনেক বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই শৈশব পার করতে হয়েছে। বয়স ৮ কিংবা ৯, সকালে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছিলেন অ্যান্টনি। হাঁটতে হাঁটতে দেখেন পায়ের সামনে কে জানি শুয়ে আছে। আরেকটু কাছে যেতেই বুঝতে দেরি হলো না যে লোকটা মৃত। সাউ-পাউলোর বস্তির মানুষগুলো এসব মুহূর্তে কোন রিয়াকশান দেখান না, অসাড় একটা অনুভূতি কাজ করে তাদের মাঝে। সেদিন পায়ের সামনে মৃত লাশটা ডিঙিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না অ্যান্টনির। স্কুলে যেতে হবে। চোখ বন্ধ করে এক লাফে লাশটাকে পিছনে ফেলে স্কুলের দিকে রওনা দেন অ্যান্টনি।
আসলে এইসবই সাউ-পাউলোর বাস্তবতা। এতকিছুর পরও অ্যান্টনি খুশি যে তার কাছে ঈশ্বরের দেওয়া একটা গিফট ছিল। ফুটবল। সাউ-পাউলোর এই ইনফার্নিনহো’তে ওদের ক্রিসমাস গিফট নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। যে কোন রাউন্ড শেপের বল মাঠে একটু গড়ালেই ওরা খুশি থাকতো।
প্রতিদিন অ্যান্টনিকে বড় ভাই ফুটবল খেলতে নিয়ে যেতেন। ওদের বস্তিতে সবাই ফুটবল খেলতো, শিশু-বৃদ্ধ-টিচার-দিন মজুর-বাস ড্রাইভার-গ্যাংস্টার-ড্রাগ ডিলার সবাই। সবাই। ওদের ফুটবল মাঠে সবাই সমান, কোন বিভেদ নেই। ওর বাবারা যখন খেলতো তখন মাঠটা ছিল বালুর, কিন্তু ওদের জেনারেশন পেয়েছিল পিচঢালা একটা গ্রাউন্ড। তাতেই সই। খেলতেন খালি পায়ে, রক্ত ঝরতো, কিন্তু খেলা থামতো না। বুট কেনার টাকা ছিল না অ্যান্টনির। সাইজে ছোট ছিলেন, কিন্তু ছিল গড-গিফটেড ড্রিবলিং স্কিল। ড্রিবলিংটা ছিল ওর রক্তে। একদম ন্যাচার ইন্সিক্টে ড্রিবল করতেন তিনি। পায়ে যখন বল থাকতো কাউকেই মানতেন না। ড্রাগ-ডিলার, গ্যাংস্টার, বাস ড্রাইভার সবাইকে হয় নাটমেগ মেরে, নাহলে রেইনবো ফ্লিক দিয়ে কাটিয়ে যেতেন তিনে। যেনো কাউকে গোণার সময়ই নেই।
ট্রিকগুলো তিনি শিখেছেন রোনালদিনহো, নেইমার, ক্রিস্টিয়ানর মতো লিজেন্ডদের থেকে। আংকেল টনিলিওর সুবাদে ইউটিউবে এসব ড্রিব্লিং দেখতেন অ্যান্টনি। আংকেল টনিলিও’র সাথে কিন্তু অ্যান্টনির কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। পাশের বাসার প্রতিবেশী আরকি। কিন্তু ফ্যামিলি মেম্বারের মতোই আদর করতেন অ্যান্টনিকে। ওয়াইফাই এর পাসওয়ার্ডতো মামুলি ব্যাপার, আংকেল টনিলিওর কাছে যদি দুই পিস ব্রেড থাকতো তাহলে এক পিস বরাদ্দ থাকতো অ্যান্টনিদের জন্য। এইটা অ্যান্টনিদের বস্তির একটা ভালো দিক। এই বস্তিতে একজন যদি খারাপ কাজ করে, তাহলে দুইজন ভালো কাজ করে।
অ্যান্টনির সবসময় মনে হতো সে ভুল জায়গায় বড় হচ্ছে, কিন্তু ঠিক মানুষের সাথে বড় হচ্ছে। বয়স তখন ৮। মাঠে গ্যাংস্টারদের সাথে খেলছিলেন অ্যান্টনি। রীতিমত নাচাচ্ছিলেন গ্যাংস্টারদের। ফেরেশতার মতো সেদিন সেখানে হাজির হয়েছিলেন এক লোক। অ্যান্টনির খেলা দেখে খোঁজ নিলেন তার সম্পর্কে। তিনি ছিলেন গ্রিমিউ ব্রুর্যারির ডিরেক্টর। এই বস্তি ছেড়ে তাদের সাথে ফুটসাল খেলার সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। শিখিয়েছিলেন স্বপ্ন দেখতে। হ্যাঁ, স্বপ্ন তো দেখাই যায়।
একদিন মায়ের সাথে বস্তিতে হাঁটছিলেন অ্যান্টনি। সামনে দিয়ে চলে গেলো লাল রঙের একটা রেঞ্জ রোভার। সবার চোখ ছিল গাড়িটাতেই। হা করে দেখছিলেন অ্যান্টনি। গাড়িটা চলে গেলে তিনি মা’কে বলেন ‘আমি যেদিন ফুটবলার হবো, সেদিন আমি এই গাড়িটাই কিনবো”। মা হাসি দিয়ে বললেন আভাস দিলেন সম্মতির। কিন্তু একদম সিরিয়াস ছিলেন অ্যান্টনি। মা’কে বললেন “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কয়েকদিন চালিয়ে তোমাকে দিয়ে দিব গাড়িটা”
তখন বাবা আর মায়ের সাথে ঘুমাতেন অ্যান্টনি। আসলে আরেকটা খাট কেনার টাকাই ছিল না। এক কাত হয়ে ঘুমালে দেখতে পারতেন বাবাকে, আরেকদিকে ফিরলে দেখতে পেতেন মাকে। ওরা খুব কাছাকাছি থাকতেন একে-অপরের। আর এই বিষয়টাই তাদের সার্ভাইভ করতে সাহায্য করতো। তারপর হঠাৎ এক ঝড় এসে জীবনটা উলটপালট করে দিল।
বয়স যখন ১১, তখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো বাবা-মা’র। এই সময়ের আগ পর্যন্ত আর কেউ না থাকলেও ওর বাবা-মা সাথে ছিলো। এখন যখন রাতে বিছানায় পাশ ফিরতেন, মা’কে আর পেতেন না। অনেক কষ্টের ছিল বিষয়টা, সেই সাথে ছিল মোটিভেশনালও। চোখ বন্ধ করে অ্যান্টনি ভাবতেন যে করেই হোক এই অবস্থা থেকে বের হতে হবে।
ভোর ৫টায় কাজের জন্য বের হয়ে যেতেন অ্যান্টনির বাবা, আর ফিরতেন রাত ৮টায়। অ্যান্টনি ওর বাবা’কে বলতেন যে বাবা যেমন এখন কষ্ট করছে অ্যান্টনির জন্য, একদিন অ্যান্টনি করবে বাবার জন্য। অ্যান্টনি বলে মিডিয়া যদি জিগ্যেস করে তার স্বপ্ন কী, তাহলে তিনি কখনোই বলবেন না তার স্বপ্ন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ-বিশ্বকাপ-ব্যালন ডর জেতা, এই গুলো হহচ্ছে গোল। তার স্বপ্ন হচ্ছে ছিল একটাই। বাবা-মা’কে এই বস্তি থেকে বের করে আনা।
১৪ বছর বয়সে সাউ-পাউলো টিমে ডাক পান অ্যান্টনি। প্রতিদিন স্কুল শেষে খালিপেটে ট্রেইনিং এ যেতেন। ফেরার সময় সবাই মিলে টাকা উঠিয়ে কিনতেন কুকি। আসলে মোটিভেটেড হবার ক্ষুধার্ত থাকার ভান করতে হয়নি তার। তার ক্ষুধাটা ছিল আসল।
অ্যান্টনির ভিতর জন্ম নিচ্ছিলো একটা ক্ষোভ। তিন-তিনবার, ক্লাব থেকে বের করেই দেয়া হচ্ছিলো তাকে। যেসব প্লেয়ারদের কন্ট্রাক্ট রিলিজ করে দেয়া হবে সেই লিস্টে নাম ছিল তার। আর তিনবারই কেউ না কেউ ম্যানেজমেন্টের হাতে-পায়ে ধরে ক্লাবে অ্যান্টনিকে ক্লাবে রেখেছিলেন কেউ না কেউ।
বেশ শুকনো ছিলেন তিনি। তার চোখ দেখলে মনে হতো তার চোখ থেকে এখনই রক্ত বের হবে। আসলে এই কাঠিন্য তার মাঝে এসেছে তার বস্তির কারণে, রাস্তা থেকে উঠে আসার কারণে। মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না, সাউ-পাউলোতে প্রফেশনাল ডেবিউ করার পরও সেই বস্তিতেই থাকতেন তিনি। ২০১৮ সালেও বাবার সাথে একই বিছানায় ঘুমাতে হতো তাকে। এছাড়া উপায় ছিল না, হয় বিছানায় বাবার সাথে ঘুমাতে হবে, নাহলে সোফায় ঘুমাতে হবে। এমনকি ২০১৯ সালেও করিন্থিয়াসের বিপক্ষে পলিস্তার ফাইনালে গোল দেয়ার পরও তাকে ফেরত যেতে হয় তার বাড়িতে, বস্তিতে। ফাইনাল শেষে তিনি যখন বস্তিতে ফিরে গিয়েছিলেন, লোকজন তার দিকে আংগুল দিয়ে দেখাচ্ছিলো একে-অপরকে। মাত্র টিভিতে দেখা স্টারকে এখানে দেখে বস্তির অনেকেই জিগ্যেস না করে পারলো না, অ্যান্টনির এখানে কি কাজ। অ্যান্টনি যখন বললো সে এখানেই থাকে, কেউই বিশ্বাস করলো না।
তার এক বছর পরেই আয়াক্স এর হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেললেন তিনি। দ্রুতই বদলে গেল সময়-ভাগ্য। নিজের বিছানাতো ছিলই, সাথে ছিল মা’কে প্রমিস করা লাল রেঞ্জ রোভার। এখন যখন মা’কে সেদিনের প্রমিসের কথা মনে করিয়ে দেন, মা শুধু কাঁদে।
বস্তি থেকে আয়াক্স, আয়াক্স থেকে সোজা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। মাত্র তিন বছরে। মানুষ প্রায়ই জিগ্যেস করে, এত জলদি এত কিছু কীভাবে সম্ভব। জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তার ফুটবল খেলায় কোনো ভয় নেই। যখন ছোটবেলায় মৃত মানুষের উপর লাফ দিয়ে পার হয়ে আপনি স্কুলে যাবেন, প্রতিদিন বন্দুক দেখবেন,তখন আর আপনার ভয় থাকবে না। অ্যান্টনি যা দেখে এসেছে অনেকে ফুটবল পন্ডিত তা কখনো ভাবতেও পারবেন না, একবার দেখে ফেললে মন থেকে ভুলাতেও পারবেন না।
অ্যান্টনির মতে, জীবনে আমাদের দুঃখ থাকবে, আমরা কাঁদবো, দুশ্চিন্তা করবো। কিন্তু যখন ফুটবল খেলার পালা, তখন মনে আনন্দ ছাড়া কোনো কিছুকেই জায়গা দেয়া যাবে না। জন্মগত ভাবেই অ্যান্টনি ছিলেন একজন ড্রিবলার। এই ড্রিবলিং স্কিল তার সংস্কৃতি-ঐতিহ্যর অংশ, যা মিশে আছে ওর রন্ধে রন্ধে। অ্যান্টনি কখনোই তার খেলার স্টাইল বদলাবেন না। কারণ এই স্টাইলটা তারই অংশ, ব্রাজিলিয়ানদের অংশ।
আপনার কাছে যদি অ্যান্টনিকে ক্লাউন মনে হয়, তাহলে আপনি ওর পুরো স্টোরিটা বুঝেননি। রোনালদিনহো, ক্রিস্টিয়ানো, নেইমারের খেলা চুরি করা ওয়াইফাইয়ে দেখে মাঠে গিয়ে তা মাস্টার করাটা ব্রাজিলের এই ছোট বস্তিবাসীর জন্য একটা আশীর্বাদ। মানুষ তাও জিগ্যেস করে, এইভাবে খেলার মানেটা কি? মেসেজটা কি?
জবাবে অ্যান্টনি শুধু বলে, তিনি তার ব্রাজিলের বস্তিবাসীদের মেসেজ দেয়। মেসেজটা এমন যে, কেউ যদি তার মতো এরকম জাহান্নামের মতো বস্তিতেও জন্মায়, তাহলে তাদের জন্য, সেই বস্তিবাসীর জন্য এই খেলার ধরণটাই স্বর্গের একটা আশীর্বাদ।
অ্যান্টনি জীবনের যেই সময়ে-যেই প্রান্তেই যাক না কেন, তিনি তার জন্মস্থান-দেশের মানুষকেই রিপ্রেজেন্ট করবেন। নিজেকে রিমাইন্ড করার জন্য, প্রতি খেলার আগে নিজের বুটের মাঝে একটা কথা লিখে রাখেন তিনি “FAVELA”. যার অর্থ “বস্তি”। যখন তিনি বুটের ফিতা বাঁধেন, তখনই তার মনে পড়ে অতীতের কথা। সাউ পাউলোর সেই বস্তির কথা।