সমুদ্র প্রীতি আমার অত নেই। যেটুকু সখ, আহ্লাদ আছে তাও অত্যন্ত পরিমারর্জিত রূপে, সমুদ্রকে একান্ত করে পাবার স্বার্র্থপরতা। দীর্র্ঘকাল চাকুরী সূত্রে কক্সবাজার থাকার দরুণ সে বিশেষ পরিমারর্জিত রূপে সমুদ্রকে একান্ত করে পাবার সে আশাও পূর্র্ণ হয়েছে বহুবার।
সেজন্যেই আর কুয়াকাটায় যাবার কোনো আকর্র্ষণ বোধ করিনি। কিন্তু পটুয়াখালী-বরগুনা যখন গেলামই ভাবলাম দেখেই যাই, কিসের অত আড়ম্বর এ জায়গা নিয়ে যে সকলে সুযোগ পাওয়া মাত্রই দলে দলে চলে। তাছাড়া শেষমুহূর্র্তে হয়ত আবার আমার মতিভ্রম হতো যদি ফারু-চান আমার সঙ্গে যাবার বায়না না ধরতো। আমার ইচ্ছে ছিল, আমার তত্ত্বাবধানে যতটুকু সম্ভব ফারু-চানকে একটু ঘুরিয়ে দেখানো চারপাশটা যদিও তার আবাস এখানেই আর আমিই বরং অতিথি।
যাত্রার শুরুতেই হলো যাত্রা বিভ্রাট!
যদিও টিকিট কেটেছি পটুয়াখালী যাব বলেই, কিন্তু তারা আমাদের ভুল টিকিট দিল। ভুল গাড়িতে উঠে ম্যাপ দেখতে দেখতে যখন অনেকদূর এগিয়ে গেলাম, তখন বুঝতে পারলাম আমরা রীতিম উল্টো দিকে চলছি!
তাড়াতাড়ি নেমে পরে সেখান থেকে রাস্তায় আরেকটা বাস ধরে আবার যাত্রা করলাম।
গুগল ম্যাপ ছাড়া অমিত জীবন কল্পনাই করতে পারিনা।
ঘন্টা দেড়েকের মাঝেই পৌঁছে গেলাম কুয়াকাটা।
যেয়েই সেন্ট মার্র্টিন নেমে যেরকম অনুভূতি হয়েছিল সেটাই হলো।
ঘিঞ্জি, নোংরা, গলাকাটা দাম, জোচ্চুরির কারখানা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আশেপাশে তাকিয়ে অবাক হলাম।
সমুদ্র সৈকত থেকে কিছুটা দূরে, এক টুকরো জায়গায় গাদাগাদি করে গড়ে উঠেছে কতগুলা সস্তা হোটেল। তার নিচেই সারিবাঁধা কতগুলো রেস্তোরাঁ, আর কিছু দোকান পাট। কয়েকশ মিটার দূরেই সমুদ্র। আর মেইন পয়েন্ট থেকে বেশ খানিক দূরে দুয়েকটা থ্রি-ষ্টার হোটেল দেখলাম।
এমনভাবে বানানো যেন, দেখে মনে হয় এইসব হোটেলের আশেপাশে থাকলে ময়লা হয়ে যাবে এই ভয়েই দূরে বানানো।
পরে বাস্তবতা মেনে নিলাম।
মধ্য-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের সমুদ্র বিলাস হলো এই জায়গা বোধহয়।
হোটেলের খোঁজে ইতিউতি করলাম। প্রথম সমস্যা হলো, "এক মেয়েছেলে'কে তারা হোটেল দেবেনা! দিলেও তা চড়া দামে!" চড়াৎ করে মাথা গরম হলো, এরকম একচেটিয়া ভ্রমণের জায়গায় এহেন গা জ্বালানো মন্তব্যে।
"তো বাছা, সবইতো ভাড়া দাও, এক রাতের জন্য না হয় একটা জামাইও ভাড়া দাও" বলতে যেয়েও সামলে নিলাম।
অবশেষে এদিক সেদিক ঘুরে, একটা হোটেল পেলাম।
বেশ মন মতোই হলো। বারান্দা থেকেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে।
ব্যবহারও ভালোই।
হোটেল ব্যাগ ট্যাগ রেখে আমরা বের হলাম। ফারু-চান ছবিটবি তুলল, পানিতে দাপাদাপি খানিকটা।
আগেই বলেছি সমুদ্র উপভোগে আমার বাপু নানান ওজর আছে। একেবারে একান্ত করে পাওয়া তার মাঝে একটি, আর পরিচ্ছন্ন সৈকত অপরটি।
সুতরাং ওকে উপভোগ করতে দেখেই আমার উপভোগ হলো।
বিকেল করে ও ঘুরেফিরে হোটেলে এসে কাপড় বদলে নিল।
আগেই বলেছি সমুদ্র উপভোগে আমার বাপু নানান ওজর আছে। একেবারে একান্ত করে পাওয়া তার মাঝে একটি, আর পরিচ্ছন্ন সৈকত অপরটি। সুতরাং ওকে উপভোগ করতে দেখেই আমার উপভোগ হলো। বিকেল করে ও ঘুরেফিরে হোটেলে এসে কাপড় বদলে নিল।
দুপুরের খাবার খেলাম এক হোটেলে।
কোনো নতুনত্ব নেই!
কক্সবাজারে খাবারের স্বাদ অত আহামরি না হলেও, সস্তা রেস্তোরাঁগুলোয় অন্তত সামুদ্রিক খাবারে আয়োজন থাকে। স্কুইড ফ্রাই বা লইট্যা ফ্রাই বিশেষত খুব ভালো লাগে পাতলা ডাল দিয়ে খেতে। অথবা চিঙড়ি বা কাঁকড়ার আর মাছের বিভিন্ন পদ থাকে। থাকে গরুর গোস্ত আর খাসির বিস্তর আয়োজন এমনকি সস্তা রেস্তোরাঁতেও।
অথচ এখানের খাবার যেকোনো এলাকালর রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁর খাবারের থেকেও মলিন।
ওকে বসে তুলে দিয়ে আমি এলাম সৈকতে। একখানা চেয়ার দখল করে বসলাম কিছুক্ষন। আশেপাশে নাকি লেবু-বাগান বলে বেশ একটা জায়গা আছে। কিন্তু গলাকাটা ভাড়া আর পরিবেশের অবস্থা দেখে না যাওয়াটাই উত্তম ধরে নিলাম।
ভাবলাম, রাত নামুক, তখন ভিড়ভাট্টা কমলে একটু সৈকতে হওয়া খেয়ে এসব আবার।
স্নানাহার সেরে একখানা ভাত ঘুম দিলাম।
সন্ধ্যায় উঠে বেরিয়ে যেতেই শুনলাম রাট ন'টা বাজলে আর সৈকতে থাকা যাবেনা! একটুখানি আশেপাশের বাজারটা চক্কর দিয়ে, রাতের খাবার খেয়ে নিলাম এক জায়গায়।
সৈকতে যেয়ে দেখি একদম শুনশান।
পাশে পুলিশের গাড়ি দেখে একটু ভরষা লাগলো।
খানিকক্ষন থেকে হোটেলরুমে চলে এলাম।
সাথে হ্যামক ছিল।
বারান্দায় ওটা টানিয়ে বই নিয়ে বসে পড়লাম। একটু পর মনে পড়লো কিছুমিছু চিবুতে ইচ্ছে করছে। নিচে নেমে দেখি ওমা, দোকান পাট সব বন্ধ! অথচ তখন রাত্রি সবে এগারোটা।
অবশেষে বয়রার সাহায্যে একখানা দোকান থেকে চা আর কিছু চিপ্স কিনে নিলাম। আমি এক মেয়ে দেখে ওরা ভালোই সাহায্য করলো।
চা ভালোই ছিল, কিন্তু আফসোস সে চায়ের দোকান তারপর পরই বন্ধ করে দিল। চা ছাড়া কি আর সময় কাটানো জমে।
হ্যামকে দুলে দুলে, সমুদ্রের বাতাসে আর গর্জনে বই পড়তে পড়তে মধ্যরাত হয়ে যায়। রাত গভীর হলো সেটা খেয়াল করতেই, হঠাৎ কেমন যেন ভয় ভয় লাগা শুরু হয়।
একা মেয়ে, এই নির্জন জায়গায়, আশেপাশে সব পুরুষদের যেন হঠাৎ ভীষণ ভয়ানক প্রাণী মনে হতে লাগলো। সাধারণত এসব ভয়ডর আমার অত নেই।
কত অচেনা, অজানা লোকের সাথে বান্দরবানের গভীরে গিয়েছি একাই, দেখা হবার আগে যাদের নাম অব্দি জানতাম না, রাত কাটিয়েছি খোলা জুম ঘরের বাঁশের পাটাতনে, ক্যাম্পিং করেছি জঙ্গলের মধ্যে, হেঁটে বেড়িয়েছি দুর্গম গহীন এলাকায়, গোসোল করেছি ঝিরির পানিতে।
তখন একবারের জন্যও কখনো ভয় ব্যাপারটাই মনে উদয় হয় নি।
অথচ এই মনুষ্য লোকালয়ে, জনমানুষের ভেতরে ছিটকিনি তুলে দেয়া একটা ঘরে আমার প্রচন্ড ভয় চেপে বসে।
আমরের সাথে বোধহয় কথা হচ্ছিলো তখন।
বলে বসলাম ওকে সে কথা। সে কিঞ্চিৎ বকুনি দিল অতি সাহসগিরি দেখাবার জন্য, আবার সাথে সাথে আশেপাশে পুলিশ কাচারীর নম্বর জোগাড় করা শুরু করে দিল। এদিকে সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে বেশ ক্লান্তিও লাগছিল, ঘুম চেপে আসছিল।
ভাবলাম, যা হয় হবে, একটা ঘুম দেই।
সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল বেশ, ঠান্ডা ঠান্ডা আবহ। বিছানায় যেয়ে কম্বল খানা টেনে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে শুতেই ঘুমিয়ে গেলাম নিমিষেই।
ঘুম ভাঙে বয়রার ডাকে।
উঠে দেখি চারিদিকে ফাককফে আলো।
হাতমুখ ধুয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে, একেবারে সব নিয়ে, তৈরী হয়ে নিচে নেমে এলাম।
ওদের ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
দিনের বেলায় রাতের সে ভয়ের ব্যাপারটা ভেবে বরং হাসিই পেলো।
কারণ?
হোটেল বেশ সস্তা ছিল, হোটেল থেকে সমুদ্র যেত, হ্যামক টানিয়ে বেশ একটা আরামের ব্যাপার হতো।
অবশ্যই পরেরবার এলে একটা দল নিয়ে আসতে হবে।
তাহলেই আর অসুবিধা হবে না।
সকালের নাস্তা করে, তবুও আরেকবার থাকার ইচ্ছে নিয়ে, বরিশালের বাস ধরলাম।
সেখান থেকে লঞ্চে ঢাকা।
All the contents are mine, untill it’s mentioned