মীরা অনেকক্ষন ধরে ভরা রৌদ্রে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে ,কিন্তু বহুবার চেষ্টার পরে অবশেষে পার হয়ে একটা গাছের নিচের ছায়ায় দাঁড়ালো | অনেকটা ঘেমে গেছে | এই সময় তেমন মানুষজন থাকে না এখানে| এই জায়গাটা মুটামুটি নির্জন| আজকে বাসায় তেমন কোন কাজ ছিলো না তাঁর| তাই হেঁটেই বের হয়েছে পোস্টঅফিস থেকে সঞ্চয় পত্রের লভ্যাংশটা নেওয়ার জন্য এবং কিছুটা সময় নিজেকে দেবার উদ্দেশ্যে| হাটতে হাটতে পোস্টঅফিসের কাছে যেতেই মনে হলো তার নাম ধরে কেউ ডাকছে পিছন থেকে| তাই পিছন ফিরে তাকাতেই একটা চশমা পড়া লোক তাকে হাত নেড়ে ডাকছে | লোকটা দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে কাছে আসতেই চিনতে পারলো | মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো
-আরে শফিক ভাই আপনি ! কতোদিন পর আপনার সাথে দেখা| কেমন আছেন আপনি ?
-আমি ভালো আছি কিন্তু তুমি কেমন আছো মীরা ? মানুষ এরকম ভাবে হারিয়ে যায় ? তোমাকে কতো খুঁজেছি ! তোমরা বাসা চেঞ্জ করেছো এবং কোথায় গেছো কেউ কিছু বলতে পারলো না | কোথায় যে ডুব মারলে তুমি ?চলো কোথাও বসি তারপর কথা বলি |
মীরা হাত ঘড়িতে তাকায় | বারোটার পর পোস্ট অফিস থেকে টাকা দিতে গড়িমসি করে | আজকে মনে হয় আর টাকা তোলা হবে না |
-এই খানে তো বসার কোনো জায়গা নেই শফিক ভাই ! ঐ গাছের নিচের ফুটপাতে বসতে পারি ! ফুটপাতে বসতে আপত্তি নেই তো আপনার ?
- কি যে বোলো না তুমি | তোমার পাশে যে কোন জায়গায় বসতে পারি আমি ,বসতে বসতে বলল শফিক |
তোমার কথা বলো মীরা ! তোমরা কেমন আছো ? সাজিদ কেমন আছে ? সাজিদের জন্য তো তোমার পাশে আমাকে ভিড়তেই দিলে না | কত চেষ্টা করলাম তোমাকে পাওয়ার জন্য |
সাজিদের কথা উঠতেই বুকটা ধ্বক করে উঠে মীরার | এই নামটা ভুলে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে গত তিন বছর ধরে | এই একটি নাম তার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে গেছে| তার জীবনে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ছিলো সাজিদ | এই শহরে লাল নীল সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলো সাজিদকে নিয়ে | অনেকটা বছর পাশাপাশি সুখ দুঃখ ভাগ করে কাটিয়ে ছিলো শুধু একটা সুন্দর সংসারের আশায় | সাজিদ গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটা ব্যাংকে চাকরী পেয়ে যায় | তারপর সাজিদ বদলে গেলো অনেকটা | খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ করতো না | ব্যাস্ততার অজুহাত ছিলো সবসময় | একদিন ব্যাংকের এক সহকর্মীকে বিয়ে করে ফেললো হুট্ করে | সে যেদিন জানতে পারলো সেদিন নিজেকে এতো একা আর অসহায় লেগেছিলো তার | জীবনটা কেমন থমকে গিয়েছিলো | - কি মীরা চুপ করে আছো যে ? বলল শফিক |
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মীরা | শফিক ভাই | সাজিদের সাথে আমার সংসার করা হয়নি | সে চাকরি পেয়ে তার এক সহকর্মীকে বিয়ে করেছে অনেকদিন আগেই |
শফিক একটু চুপ থেকে বলল , - আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম মীরা | সাজিদ তোমাকে বিয়ে করবে না | তখন আমার কথা শোনোনি |
- শফিক ভাই আমরা মানুষ সব সময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি | ভুল মানুষকে ভালোবাসি বলেই আমরা সঠিক মানুষ কাছে থাকলেও সেই মানুষকে চিনি না | এটাই হয়তো জীবনের নিয়ম | আর কোন মানুষটা ভুল আর কোন মানুষটা সঠিক সেটা আমরা কখনোই চিনতে পারি না বলেই ভালোবাসায় হিসাব নিকাশ হয় না | আর যখন হিসাব করা হয় তখন বুঝতে পারি ভুল না ঠিক |
-তুমি আগের মতোই সুন্দর করে কথা বলো মীরা !
-এখন মনে হয় শফিক ভাই সেই সময় সব কিছু ছেড়ে যদি আপনাকেই ভালোবাসতাম তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো | কিংবা আপনিও একসময় ভুল ডিসিশন হয়ে যেতেন | - কি জানি ! জীবন কখন কার কাছে কিভাবে ধরা দেয় কেউ কখনো বলতে পারে না |
-তবে এখন মনে হয় ভালোবাসার কোন ভুল নেই ,ভুল আসলে মানুষের মানুষ চিনার | আমরা কি সবসময় মানুষ চিনতে পারি সফিক ভাই ?
এমন সময় কেউ শফিক ! এই শফিক বলে ডাকছে |
শফিক ভাই ব্যাস্ত হয়ে বলল ,এখন যাই মীরা | তোমার ভাবী চলে আসছে | বলেই হন্ত দন্ত হয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো |
মীরা এতক্ষণ পর লক্ষ্য করলো শফিক ভাই স্যুটেটবুটেট একজন হাউজ হাসবেন্ড |
আচ্ছা সাজিদ কি এরকম হয়ে গেছে ! হাউস হাসবেন্ড | মীরার হাসি পায়| যারা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেনা তারা আর যাই হউক পুরুষ হতে পারে না |
মীরা হাটতে থাকে | হাটতে হাটতে নিজের মনে কত কথা ভেবে যাচ্ছে | একটা মানুষ যখন হাত ছেড়ে চলে যায় তখন সেই ছেড়ে যাওয়ার হাতের অভাব কোন কিছু দিয়ে পূরণ হয় না | এই শহরে চারপাশে এতো মানুষ থাকার পরেও ছেড়ে যাওয়া হাতের জন্য মনে হয় কোথাও কেউ নেই|
সূর্যের আলোতে তার ছায়া পড়ছে মাটিতে | মানুষের ছায়া যখন মানুষের চেয়ে বড় হয় তখন বুঝতে হয় সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে|